মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে খাবার খেতেন । ইসলামের প্রতিটি দিকের মতো খাবার গ্রহণের বিষয়েও কিছু নির্দিষ্ট আদর্শ ও আচরণ রয়েছে । এবং যা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জীবনাচরণের মাধ্যমে আমাদেরকে শিখিয়েছেন। তার প্রতিটি কাজ ছিল সহজ, সুন্দর এবং স্বাস্থ্যসম্মত। খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে সুন্নাহ মেনে চললে তা আমাদের শারীরিক ও মানসিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
খাবার খাওয়ার সুন্নাহ পদ্ধতির কিছু মূলনীতি:
১. হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ : খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো, তা হালাল হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, _"হে মুমিনগণ! তোমরা আমার দেয়া রিজিক থেকে হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ কর"_ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৬৮)। হালাল খাবার শুধু শরীরকে পুষ্টি দেয় না, বরং আত্মারও পরিশুদ্ধি করে।
২. বিসমিল্লাহ বলা : খাবার খাওয়া শুরু করার আগে "বিসমিল্লাহ" বলতে হবে। হাদিসে আছে, _"যখন তোমাদের কেউ খাবার খাবে, সে যেন 'বিসমিল্লাহ' বলে শুরু করে"_ (তিরমিজি)। এতে খাবারে বরকত হয় এবং শয়তানকে খাবারে অংশীদারিত্ব থেকে দূরে রাখা হয়।
৩. ডান হাতে খাওয়া : মহানবী (সা.) সর্বদা ডান হাতে খাবার গ্রহণ করতেন। তিনি বলতেন, _"তোমরা ডান হাতে খাও এবং ডান হাতে পান কর"_ (মুসলিম)। ডান হাতে খাওয়া সুন্নাহ এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করা হয়।
৪. তিন আঙ্গুলে খাওয়া : মহানবী (সা.) সাধারণত তিন আঙ্গুল ব্যবহার করে খাবার খেতেন। হাদিসে এসেছে, _"রাসূলুল্লাহ (সা.) তিন আঙ্গুল দিয়ে খাবার গ্রহণ করতেন এবং আঙ্গুলগুলো ভালোভাবে চেটে নিতেন"_ (মুসলিম)। এতে খাবারের অপচয় কম হয় এবং এটি খাওয়ার একটি মার্জিত পদ্ধতি।
৫. নিজের সামনে থেকে খাওয়া : খাওয়ার সময় নিজের সামনে থেকে খাওয়া সুন্নাহ। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, _"রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমরা তোমাদের সামনে থেকে খাবে"_ (বুখারি)। এটি শিষ্টাচারের অংশ এবং খাবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি।
মহানবী (সা.) এর খাবার খাওয়ার শিষ্টাচার
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর খাবার খাওয়ার অভ্যাসগুলো ছিল স্বাস্থ্যকর ও পরিমিত। তিনি কখনো অতিরিক্ত খাবার খেতেন না এবং সব সময় সংযম বজায় রাখতেন। নিচে তার খাবার গ্রহণের কিছু মূলনীতি আলোচনা করা হলো:
১. পরিমাণমতো খাওয়া : তিনি সব সময় পরিমাণমতো খেতেন এবং বলতেন, _"কোনো মানুষ তার পেটের চেয়ে খারাপ কিছু পূর্ণ করেনি। মানুষের জন্য কয়েকটি লোকমা যথেষ্ট যা তাকে শক্তিশালী রাখবে। আর যদি সে পূর্ণ করতে চায়, তবে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাসের জন্য"_ (তিরমিজি)। এই পরামর্শ শুধু আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয় না, বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষার একটি বড় উপায়।
২. অধিক গরম খাবার এড়ানো : মহানবী (সা.) গরম খাবার খাওয়া পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, _"খাবার ঠাণ্ডা হওয়ার পরই তা গ্রহণ করো, কারণ গরম খাবারে বরকত থাকে না"_ (আবু দাউদ)। এটি তার সুন্নাহ এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
৩. সবচেয়ে আগে অন্যদের পরিবেশন করা : রাসূলুল্লাহ (সা.) সবসময় অন্যদের আগে খাবার পরিবেশন করতেন এবং শেষে নিজের জন্য রাখতেন। এটা ছিল তার দয়ালুতা এবং বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ। হাদিসে আছে, _"তুমি নিজের জন্য যা ভালো মনে কর, তা অন্যদের জন্যও ভালো মনে কর"_ (বুখারি)। এই শিক্ষা সামাজিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে এবং একে অপরের প্রতি ভালবাসা ও সম্মান বৃদ্ধি করে।
৪. খাবার চিবিয়ে খাওয়া : মহানবী (সা.) কখনো তাড়াহুড়ো করে খাবার গ্রহণ করতেন না। তিনি ভালোভাবে চিবিয়ে, ধীরে ধীরে খাবার খেতেন। এতে খাবার হজম সহজ হয় এবং শরীর ভালোভাবে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে।
৫. খাবার ভাগাভাগি করা : রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় অন্যদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেতেন। হাদিসে আছে, _"দু'জনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট এবং তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট"_ (মুসলিম)। এতে খাবারের বরকত বৃদ্ধি পায় এবং একটি সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়।
৬. বিয়ে করার পর সুন্নাহ : নবীজি (সা.) বিয়ের পর তার স্ত্রীদের সাথে একসাথে বসে খাবার খেতেন। তিনি তাদেরকে সুন্নাহ পদ্ধতিতে খাবার খেতে শেখাতেন এবং উৎসাহিত করতেন।
খাবারের পরে সুন্নাহ
১. আঙ্গুল চেটে পরিষ্কার করা : মহানবী (সা.) খাওয়া শেষে আঙ্গুলগুলো চেটে পরিষ্কার করতেন এবং অন্যদেরও তা করতে পরামর্শ দিতেন। তিনি বলতেন, _"তোমাদের কেউ যেন তার আঙ্গুলগুলো পরিষ্কার করার আগে চেটে না নেয়, কেননা সে জানে না কোন অংশে বরকত রয়েছে"_ (মুসলিম)।
২. আলহামদুলিল্লাহ বলা : খাবার খাওয়ার পরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য 'আলহামদুলিল্লাহ' বলা সুন্নাহ। মহানবী (সা.) সব সময় খাবার শেষ করার পর আল্লাহর প্রশংসা করতেন। এতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হয় এবং আল্লাহ তায়ালা আরো বরকত দান করেন।
৩. জমিনে বসে খাওয়া : রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত জমিনে বসে খেতেন। হাদিসে এসেছে, _"আমি একজন দাসের মতো বসি এবং একজন দাসের মতো খাই"_ (আবু দাউদ)। জমিনে বসে খাওয়া সুস্থতার প্রতীক এবং আত্মসম্মান ও বিনয় বৃদ্ধি করে।
খাবারের সুন্নাহর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব
মহানবী (সা.) এর খাবার খাওয়ার সুন্নাহ শুধু ধর্মীয় আচরণ নয়, এর পেছনে রয়েছে গভীর বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত তাৎপর্য। যেমন:
১. চিবিয়ে খাওয়া : খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া হজমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে খাবারের এনজাইমগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারে এবং হজমপ্রক্রিয়া সহজ হয়।
২. পরিমাণমতো খাওয়া : অল্প পরিমাণে খাওয়া স্থূলতা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও এটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
৩. গরম খাবার এড়ানো : খুব গরম খাবার হজমপ্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং মুখ ও গলা পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই সুন্নাহ মেনে চলা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
৪. হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ : হালাল খাবার শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।
উপসংহার
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাবার খাওয়ার সুন্নাহ আমাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এর প্রতিটি দিক আমাদের শারীরিক ও মানসিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সুন্নাহ অনুসরণ করে আমরা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি না, বরং এটি আমাদের স্বাস্থ্য ও সমাজের শান্তির জন্যও অপরিহার্য।
Warning!
এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সকল কন্টেন্ট (লেখা, ছবি, ভিডিও, ইত্যাদি) কপিরাইট আইনের অধীনে সুরক্ষিত। এডমিনের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো অংশ কপি, পুনরায় প্রকাশ, কিংবা অন্য কোথাও ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অনুমতি ছাড়া আমাদের কন্টেন্ট কপি করলে, তা কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের শামিল হবে এবং এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।